জাপানে পড়তে যাওয়া এক ছাত্রী একদিন দেশে ফোন করে বলল, খুব লজ্জায় আছি!
– কেন কী হয়েছে?”
– ড্রইং ক্লাসে ড্রইং বক্স নিয়ে যাইনি।
– তো?
– জাপানি স্যার একটা বড় শিক্ষা দিয়েছেন।
– কী করেছেন?
– আমার কাছে এসে ক্ষমা চেয়েছেন! বলেছেন, আজ যে ড্রইং বক্স নিয়ে আসতে হবে, তা স্মরণে রাখার মতো জোর দিয়ে তিনি আমাকে বলতে পারেননি। তাই তিনি দুঃখিত।
– হুম।
– আমি তো আর কোনদিন ড্রইং বক্স নিতে ভুলব না। আজ যদি তিনি আমাকে বকতেন বা অন্য কোনো শাস্তি দিতেন, আমি হয়ত কোনও একটা মিথ্যা অজুহাত দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতাম!
জাপানি দল বিশ্বকাপে হেরে গেলেও জাপানি দর্শকরা গ্যালারি পরিষ্কার করে তবেই স্টেডিয়াম ত্যাগ করে।
এ আবার কেমন কথা?
এটা কি কোনো পরাজয়ের ভাষা! হেরেছিস যখন রেফারির চৌদ্দ গুষ্টি তুলে গালি দে। বলে দে, পয়সা খেয়েছে। বিয়ারের ক্যান, কোকের ক্যান, চীনাবাদামের খোসা যা পাস ছুঁড়ে দে। দুই দিন হরতাল ডাক। অন্তত বুদ্ধিজীবীদের ভাষায় এটা তো বলতে পারিস যে, খেলোয়াড় নির্বাচন ঠিক হয়নি, এতে সরকার বা বিরোধী দলের হাত আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে গিয়ে জাপানের সম্রাট হিরোহিতো আমেরিকার প্রতিনিধি ম্যাক আর্থারের কাছে গেলেন। প্রতীক হিসেবে নিয়ে গেলেন এক ব্যাগ চাল। হারিকিরির ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে মাথা পেতে দিয়ে বললেন, “আমার মাথা কেটে নিন আর এই চালটুকু গ্রহণ করুন। আমার প্রজাদের রক্ষা করুন। ওরা ভাত পছন্দ করে। ওদের যেন ভাতের অভাব না হয়!”
আরে ব্যাটা, তুই যুদ্ধে হেরেছিস, তোর আত্মীয়স্বজন নিয়ে পালিয়ে যা। তোর দেশের চারদিকেই তো জল। নৌপথে কিভাবে পালাতে হয় আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নে। কোরিয়া বা তাইওয়ান যা। ওখানকার মীর জাফরদের সাথে হাত মেলা। সেখান থেকে হুঙ্কার দে।
সম্রাট হিরোহিতো এসব কিছুই করলেন না। তার এই আচরণ আমেরিকানদের পছন্দ হলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কুখ্যাত মহানায়কদের মধ্যে কেবলমাত্র হিরোহিতোকেই বিনা আঘাতে বাঁচিয়ে রাখা হলো।
২০১১ সালের ১১ই মার্চ। সুনামির আগমন বার্তা শুনে এক ফিশারি কোম্পানির মালিক সাতো সান প্রথমেই বাঁচাতে গেলেন তার কর্মচারীদের। হাতে সময় আছে মাত্র ৩০ মিনিট। প্রায়োরিটি দিলেন বিদেশি চাইনিজদের। একে একে সব কর্মচারীদের অফিস থেকে বের করে পাশের উঁচু টিলায় নিজে পথ দেখিয়ে গিয়ে রেখে এলেন। সর্বশেষে গেলেন তার পরিবারের খোঁজ নিতে। ইতিমধ্যে সুনামি এসে হাজির। সাতো সানকে চোখের সামনে পরিবার সহ কোলে তুলে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সুনামি! আজও খোঁজহীন হয়ে আছেন তার পরিবার। ইস! সাতো সান যদি একবার বাঙালিদের সাথে দেখা করার সুযোগ পেতেন। তাহলে শিখতে পারতেন নিজে বাঁচলে বাপের নাম!
সাতো সান অমর হলেন চায়নাতে। চাইনিজরা দেশে ফিরে গিয়ে শহরের চৌরাস্তায় ওনার প্রতিকৃতি বানিয়ে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
নয় বছরের এক ছেলে স্কুলে ক্লাস করছিল। সুনামির সতর্ক সংকেত শুনে স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানাল এবং সব ছাত্রদের নিয়ে তিন তলায় জড়ো করল। তিন তলার ব্যালকনি থেকে সে দেখল তার বাবা স্কুলে আসছে গাড়ি নিয়ে। গাড়িকে ধাওয়া করে আসছে প্রলয়ংকারী জলের সৈন্যদল। গাড়ির স্পিড জলের স্পিডের কাছে হার মেনে গেল। চোখের সামনে নেই হয়ে গেল বাবা! সৈকতের কাছেই ছিল তাদের বাড়ি। শুনলো, মা আর ছোট ভাই ভেসে গেছে আরো আগে।
পরিবারের সবাইকে হারিয়ে ছেলেটি আশ্রয় শিবিরে উঠল। শিবিরের সবাই খিদে আর শীতে কাঁপছে। ভলান্টিয়াররা রুটি বিলি করছে। আশ্রিতরা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটিও আছে সবার সাথে। এক বিদেশী সাংবাদিক দেখলেন, যতখানি রুটি আছে তাতে লাইনের সবার হবে না। ছেলেটির কপালে খাবার জুটবে না। সাংবাদিক তার কোটের পকেটে রাখা নিজের ভাগের রুটি দুটো ছেলেটিকে দিলেন। ছেলেটি ধন্যবাদ জানিয়ে রুটি গ্রহণ করল, তারপর যেখান থেকে রুটি বিলি হচ্ছিল সেখানেই ফেরত দিয়ে আবার লাইনে এসে দাঁড়াল।
সাংবাদিক কৌতূহল চাপতে পারলেন না। ছেলেটিকে জিজ্ঞাস করলেন, “এ কাজ কেন করলে খোকা?”
খোকা উত্তর দিল, বন্টন তো ওখান থেকে হচ্ছে। ওদের হাতে থাকলে, বন্টনে সমতা আসবে।তাছাড়া লাইনে আমার চেয়েও বেশি ক্ষুধার্ত লোক থাকতে পারে!
সহানুভুতিশীল হতে গিয়ে বন্টনে অসমতা এনেছেন, এই ভেবে সাংবাদিকের পাপবোধ হলো। ওই ছেলের কাছে কী বলে ক্ষমা চাইবেন ভাষা হারালেন তিনি।
যাদের জাপান সম্পর্কে ধারণা আছে তারা সবাই জানেন, যদি ট্রেনে বা বাসে কোনো জিনিস হারিয়ে যায়, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। ওই জিনিস আপনি অক্ষত অবস্থায় ফেরত পাবেন।
গভীর রাতে কোনো ট্রাফিক নেই, কিন্তু পথচারীরা ট্রাফিক বাতি সবুজ না হওয়া পর্যন্ত পথ পার হচ্ছেন না।
ট্রেনে বাসে টিকিট ফাঁকি দেওয়ার হার শূন্যের কোঠায়।
একবার ভুলে ঘরের দরজা লক না করে এক প্রবাসী দেশে গেলেন। মাস খানেক পর এসে দেখেন, যেমন ঘর রেখে গেছেন, ঠিক তেমনই আছে!
এই শিক্ষা জাপানিরা কোথায় পান?
সামাজিক শিক্ষা শুরু হয় কিন্ডারগার্টেন লেভেল থেকে।
সর্বপ্রথম যে তিনটি শব্দ এদের শেখানো হয় তা হলো:
*কননিচিওয়া* (হ্যালো): পরিচিত মানুষকে দেখা মাত্র হ্যালো বলবে।
*আরিগাতোউ* (ধন্যবাদ): সমাজে বাস করতে হলে একে অপরকে উপকার করবে। তুমি যদি বিন্দুমাত্র কারো দ্বারা উপকৃত হও তাহলে ধন্যবাদ দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।
*গোমেননাসাই* (দুঃখিত): মানুষ মাত্রই ভুল করে এবং সেই ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবে।
এগুলো যে শুধু স্কুলে মুখস্ত করতে শেখানো হয় ব্যাপারটা তা নয়। বাস্তব জীবনেও শিক্ষকরা সুযোগ পেলেই এগুলো ব্যবহার করেন এবং শিক্ষার্থীদেরকেও করিয়ে ছাড়েন।
সমাজে এই তিনটি শব্দের গুরুত্ব কতটা তা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছেন। এই প্র্যাকটিসগুলি ওরা বাল্যকাল থেকে করতে শেখে। কিন্ডারগার্টেন থেকেই স্বনির্ভরতার ট্রেনিং দেওয়া হয়।
আমাদের দেশের দিক নির্দেশকরা তাদের শৈশব যদি কোনও রকমে জাপানের কিন্ডারগার্টেনে কাটিয়ে আসতে পারতেন তাহলে কী ভালোটাই না হতো!
একজন আত্মনির্ভরশীল মানুষ হিসেবে বসবাস করার জন্য যা যা দরকার অর্থাৎ নিজের বইখাতা, খেলনা, পোশাক, বিছানা সব নিজে গোছানো, টয়লেট ব্যবহার করে নিজেই পরিষ্কার করা, খাবার খেয়ে নিজের খাবারের প্লেট নিজেই ধুয়ে ফেলা ইত্যাদি।
প্রাইমারি স্কুল থেকে জাপানি ছেলেমেয়েরা নিজেরা দল বেঁধে স্কুলে যায়। দল ঠিক করে দেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। ট্রাফিক আইন, বাস ট্রেনে চড়ার নিয়ম কানুন সবই শেখানো হয়।
আপনার গাড়ি আছে, বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আসতে গেলেন, আপনার সম্মান তো বাড়বেই না, উল্টো আপনাকে লজ্জা পেয়ে আসতে হবে।
ক্লাস সেভেন থেকে সাইকেল চালিয়ে তারা স্কুলে যায়। ক্লাসে কে ধনী, কে গরীব, কে প্রথম, কে দ্বিতীয় এসব বৈষম্য যেন তৈরি না হয় সেজন্য যথেষ্ট সতর্ক থাকেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।
ক্লাসে রোল নং ১ মানে এই নয় যে একাডেমিক পারফরম্যান্স সবচেয়ে ভাল। রোল তৈরি হয় নামের বানানের আদ্যাক্ষরের ক্রমানুসারে!
বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সমস্ত আইটেমগুলো থাকে গ্রুপ পারফরম্যান্স দেখার জন্য, ইন্ডিভিজুয়াল পারফরম্যান্সের জন্য নয়! ওখানে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের গুরুত্বের চেয়ে টিম ওয়ার্কের গুরুত্ব অনেক বেশি।
সারা স্কুলের ছেলেমেয়েদের ভাগ করা হয় কয়েকটি গ্রুপে। লাল দল, নীল দল, সবুজ দল, হলুদ দল ইত্যাদি। গ্রুপে কাজ করার ট্রেনিংটা ছাত্রছাত্রীরা পেয়ে যায় স্কুলের খেলাধুলা, ছবি আঁকা জাতীয় এক্সট্রা কারিকুলার এ্যাক্টিভিটি থেকে।
এই জন্যই হয়তো জাপানে তথাকথিত ‘লিডার’ তৈরি হয় না, কিন্তু এরা সবাই একত্রে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লিডার!
তথ্য সংগ্রহীত