_________________________
_*মমতাজ উদ্দিন আহমদ*_
_________________________
কাজী নজরুল ইসলাম, বাংলা সাহিত্যে যিনি দ্রোহ ও প্রেমের এক অনন্য মিশ্রণ ঘটিয়েছেন, তাঁর ইসলামী গানগুলো গভীর ভক্তিমূলক অনুভূতির প্রকাশ। "ওরে কে বলে আরবে নদী নাই" তেমনই এক অসাধারণ আধ্যাত্মিক প্রেমের গান। এটি আরবের মরুভূমিকে প্রেমের দরিয়া, আল্লাহ্র রহমত ও পুণ্যের উৎস হিসেবে চিত্রিত করে। এই গান একদিকে যেমন ইসলামী ঐতিহ্যের প্রতি নজরুলের গভীর শ্রদ্ধাকে তুলে ধরে, তেমনি অন্যদিকে তাঁর সর্বজনীন প্রেম ও ভক্তির সুরকেও মূর্ত করে তোলে।
*গানের মূলভাব ও প্রেক্ষাপট*
এই গানে কবি একটি প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন – 'আরবে নদী নেই'। তিনি ভৌগোলিক নদীকে ছাপিয়ে এক আধ্যাত্মিক ও অদৃশ্য নদীর কথা বলেছেন। এই নদী হলো আল্লাহ্র রহমত, প্রেম এবং পবিত্রতার স্রোত। আরবের পবিত্র স্থানগুলো, যেমন কাবা ঘরের পাশে প্রবাহিত আব-এ-জমজম, এখানে আল্লাহ্র নামের বৃষ্টির মতো ঝরছে। এই আধ্যাত্মিক নদীর জোয়ার সারা বিশ্বে পুণ্যের বাগান তৈরি করেছে। ইরাকের ফোরাত নদীর বিষাদের স্মৃতিও এখানে মানবজাতির চোখের জলের মাধ্যমে প্রবাহিত এক অনন্ত নদীর প্রতীক হয়ে উঠেছে। এটি বিশ্বাস ও ভক্তির মাধ্যমে জীবনের সকল বিষণ্নতা দূর করে এক আনন্দময় জীবনের ইঙ্গিত দেয়।
*পঙক্তিভিত্তিক আলোচনা ও কাব্যিক তাৎপর্য*
গানটির প্রতিটি পঙক্তি গভীর আধ্যাত্মিক অর্থ ও কাব্যিক সৌন্দর্যে ভরপুর:
*• "ওরে কে বলে আরবে নদী নাই যথা রহ্মতের ঢল বহে অবিরল দেখি প্রেম-দরিয়ার পানি, যেদিকে চাই॥"*
গানটি শুরু হয় একটি দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে। কবি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন – আরবে নদী নেই কে বলেছে? তিনি আরবের রুক্ষ ভূখণ্ডে দেখতে পান আল্লাহ্র অবিরাম রহমতের ঢল, যা অবিরাম ধারায় প্রবাহিত। তাঁর চোখে এই ঢল কোনো সাধারণ নদী নয়; এটি 'প্রেম-দরিয়া'র পানি। এই প্রেম-দরিয়া হলো আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তির অনন্ত উৎস।
*• "যাঁর ক্বাবা ঘরের পাশে আব্-এ-জম্জম্ যথা আল্লা-নামের বাদল ঝরে হরদম, যার জোয়ার এসে দুনিয়ার দেশে দেশে পুণ্যের গুলিস্তান রচিল দেখিতে পাই॥"*
কাবা ঘরের পাশে প্রবাহিত আব-এ-জমজম হলো একটি পবিত্র ঝর্ণা। কবি এটিকে 'আল্লা-নামের বাদল' বা আল্লাহ্র নামের বৃষ্টি হিসেবে দেখেছেন, যা নিরন্তর ঝরছে। এই আধ্যাত্মিক বৃষ্টি বা প্রেমের জোয়ার দুনিয়ার আনাচে-কানাচে পৌঁছে গেছে। যেখানেই এই জোয়ার পৌঁছেছে, সেখানেই যেন 'পুণ্যের গুলিস্তান' বা পুণ্যের বাগান তৈরি হয়েছে। এটি ইসলামের বিশ্বজনীন বার্তা ও তার ইতিবাচক প্রভাবের প্রতীক।
*• "যার ফোরাতের পানি আজো ধরার 'পরে নিখিল নর-নারীর চোখে ঝরে ওরে শুকায় না যে নদী দুনিয়ায়, যার শক্তির বন্যার তরঙ্গ-বেগে যত বিষণ্ন-প্রাণ ওরে আনন্দে উঠল জেগে যাঁর প্রেম-নদীতে, যাঁর পুণ্য-তরীতে মোরা ত'রে যাই॥"*
ফোরাত নদীটি ইরাকে অবস্থিত এবং এটি কারবালার বিষাদময় ঘটনার সাক্ষী। কবি এখানে ফোরাতের পানিকে কেবল ভৌগোলিক নদী হিসেবে দেখেননি। তাঁর কাছে এই পানি হলো নিখিল নর-নারীর চোখে ঝরা শোক ও প্রেমের অশ্রু, যা কখনোই শুকায় না। এটি এক অনন্ত মানবীয় বেদনার প্রতীক, যা স্মৃতির মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়। এই নদীর শক্তির বন্যা অর্থাৎ এর আধ্যাত্মিক প্রভাব বা শিক্ষার তরঙ্গ-বেগে যত বিষণ্ন প্রাণ ছিল, তারা যেন আনন্দে জেগে উঠেছে। শেষ পঙক্তিতে কবি বলেছেন, সেই মহান সত্তার প্রেম-নদীতে এবং তাঁর পুণ্য-তরীতে চড়ে মানুষ সকল দুঃখ ও বাধা পেরিয়ে যায়। এটি মুক্তি ও পরিত্রাণের এক গভীর বিশ্বাসকে প্রকাশ করে।
*গানে ব্যবহৃত ইসলামী পরিভাষাসমূহ*
নজরুলের এই গানে বেশ কিছু ইসলামী পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, যা গানের আধ্যাত্মিক গভীরতা বৃদ্ধি করেছে:
*• আরব:* এটি ভৌগোলিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের আরব উপদ্বীপকে বোঝায়, যা ইসলামের উৎপত্তিস্থল এবং পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনার অবস্থান নির্দেশ করে। গানে এটি আধ্যাত্মিক কেন্দ্রবিন্দুর প্রতীক।
*• রহমত:* আরবি শব্দ, যার অর্থ আল্লাহ্র দয়া, করুণা বা আশীর্বাদ। গানে এটি আল্লাহ্র অশেষ কৃপা ও অনুগ্রহের ধারাকে বোঝায়।
*• প্রেম-দরিয়া:* 'প্রেম' বাংলা শব্দ হলেও 'দরিয়া' ফারসি শব্দ, যার অর্থ নদী বা সমুদ্র। এটি আল্লাহ্র প্রতি বা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আসা সীমাহীন ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিক প্রবাহকে বোঝায়।
*• ক্বাবা ঘর:* মক্কার মসজিদুল হারামের কেন্দ্রে অবস্থিত ঘনাকৃতির পবিত্র স্থাপনা। মুসলিমদের কিবলা, অর্থাৎ নামাজের দিক। এটি ইসলামে অত্যন্ত পবিত্র স্থান।
*• আব-এ-জমজম:* মক্কাতে অবস্থিত অলৌকিক ঝর্ণা বা কূপের পানি। এর অর্থ 'জমজমের পানি' ('আব' ফারসি শব্দ, যার অর্থ পানি)। এর উৎপত্তি হযরত ইবরাহিম (আ.), তাঁর স্ত্রী হাজেরা (আ.) এবং শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.)-এর সাথে জড়িত। ইসলামি বর্ণনা অনুযায়ী, পানির অভাবে ইসমাইল (আ.) যখন তৃষ্ণায় কাতর হন, তখন আল্লাহ্র কুদরতে এই ফোয়ারা বেরিয়ে আসে। প্রায় চার হাজার বছর ধরে এই কূপ থেকে একটানা পানি পাওয়া যাচ্ছে, যা এর অলৌকিকতার এক বড় প্রমাণ। মুসলিমরা জমজমের পানিকে অত্যন্ত পবিত্র, বরকতময় ও রোগ নিরাময়ে সক্ষম বলে বিশ্বাস করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "জমজমের পানি যে উদ্দেশ্য নিয়ে পান করবে তা পূরণ হবে।" (সুনানে ইবনে মাজাহ)। জমজম কূপ কাবাঘরের প্রায় ২০ মিটার পূর্বে অবস্থিত এবং এর মাহাত্ম্য কাবার ফজিলতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
*• আল্লা-নামের বাদল:* 'বাদল' মানে মেঘ বা বৃষ্টি। এটি আল্লাহ্র নামের আধ্যাত্মিক শক্তি ও তার ফলস্বরূপ বর্ষিত অগণিত কল্যাণ ও প্রাচুর্যকে চিত্রিত করে।
*• পুণ্যের গুলিস্তান:* 'পুণ্য' মানে সওয়াব বা নেকি, এবং 'গুলিস্তান' ফারসি শব্দ যার অর্থ গোলাপ বাগান। এটি ভালো কাজ ও সৎকর্মের ফলস্বরূপ সৃষ্ট এক সুন্দর ও পবিত্র পরিবেশকে বোঝায়।
*• ফোরাত:* মধ্যপ্রাচ্যের একটি ঐতিহাসিক নদী (ইউফ্রেটিস)। ইসলামে, বিশেষ করে শিয়া মুসলিমদের কাছে, এটি কারবালার শোকাবহ ঘটনার সাথে গভীরভাবে জড়িত। গানে এটি মানবজাতির সম্মিলিত বেদনা ও স্মৃতির প্রতীক।
*• পুণ্য-তরী:* 'পুণ্য' মানে পুণ্যবান বা পবিত্র। 'তরী' মানে নৌকা। এটি ইসলামের শিক্ষা, আল্লাহ্র পথ বা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শকে বোঝায়, যা মানুষকে ইহকাল ও পরকালের সংকট থেকে মুক্তি দেয়।
*কাব্যিক ও শৈল্পিক তাৎপর্য*
এই গানটি নজরুলের আধ্যাত্মিক ভক্তির এক অনবদ্য উদাহরণ। তিনি এখানে ভৌগোলিক ধারণাকে ছাড়িয়ে এক গভীর আধ্যাত্মিক সত্যকে তুলে ধরেছেন। আরবের শুষ্কতার বিপরীতে রহমত, প্রেম ও পুণ্যের অফুরন্ত প্রবাহের চিত্রায়ণ এক অসাধারণ কাব্যিক সৃষ্টি। 'প্রেম-দরিয়া', 'আল্লা-নামের বাদল', 'পুণ্যের গুলিস্তান'—এই রূপকগুলো নজরুলের অসাধারণ শব্দচয়ন ও চিত্রকল্পের নিদর্শন। তাঁর ইসলামী গানগুলোতে প্রচলিত শব্দাবলির পাশাপাশি ফারসি ও আরবি শব্দের ব্যবহার এক বিশেষ আবহ তৈরি করে, যা এই গানটিতেও স্পষ্ট। এটি কেবল একটি ভক্তিগীতি নয়, এটি মানবাত্মার জাগরণ ও আধ্যাত্মিক উত্তরণের এক অনন্ত যাত্রার গান।
*রচনাকাল ও প্রকাশনা তথ্য*
গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। তবে ১৯৩৮ সালের এপ্রিল মাসে (চৈত্র ১৩৪৪ - বৈশাখ ১৩৪৫) টুইন রেকর্ড কোম্পানি এটি প্রথম রেকর্ড প্রকাশ করে। এই সময় নজরুল ইসলামের বয়স ছিল ৩৮ বছর ১০ মাস। গানটি শিল্পী আব্বাস উদ্দীন-এর কণ্ঠে প্রকাশিত হয় এবং এর সুরকার ছিলেন গিরীন চক্রবর্তী। সুধীন দাশ তাঁর 'নজরুল-সঙ্গীত স্বরলিপি তৃতীয় খণ্ড'-এ গানটির স্বরলিপি সংকলন করেছেন। এটি ইসলামী গান পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত এবং এটি দ্রুত দাদরা তালে নিবদ্ধ। গানটির গ্রহস্বর গা।
*লেখক: সভাপতি, আলীকদম প্রেসক্লাব, বান্দরবান পার্বত্য জেলা।*
তারিখ: ১১ জুন ২০২৫ খ্রি.
সম্পাদক-প্রকাশক: মোঃ তৌহিদুল ইসলাম । নির্বাহী সম্পাদক: মোঃ শাহনেওয়াজ। বার্তা সম্পাদক: মোঃ হাসেম।
ঘরে বসে আপনার পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিন 09638-574273 - 01616-885650